কম্পিউটার একটি আধুনিক অত্যন্ত দ্রুতি গতি সম্পন্ন ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র। অন্যান্য ইলেট্রনিক্স যন্ত্রের সাহায্যে দুই-তিনটির বেশী কাজ করা যায় না। কিন্তু কম্পিউটারের সাহায্যে অনেক রকম দুরূহ কাজ নিখুতভাবে করা সম্ভব। কম্পিউটারের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হল
১. এটি লক্ষ লক্ষ তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে।
২. অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ও নির্ভুলভাবে নির্দেশিত নির্দেশসমূহ পালন করতে পারে।
কম্পিউটারের বাংলা অর্থ হল গণকযন্ত্র । কম্পিউটারের ভাষা/ল্যাংগুয়েজই হল কম্পিউটারের প্রোগ্রাম। প্রোগ্রাম ব্যতীত কম্পিউটার একটি জড় পদার্থ।
কম্পিউটার এর সংজ্ঞা ঃ
‘‘কম্পিউটার হলো একগুচ্ছ বৈদুতিক তরঙ্গকে নিজস্ব সংকেতে রূপান্তর করে ব্যবহারকারী কর্তৃক প্রয়োগকৃত কমান্ডের সাহ্যায্যে উদ্ভূ সমস্যার সমাধান করে থাকে।’’
কম্পিউটারের উৎপত্তি:
১৬৭১ সালে জার্মান গণিতবিদ গটফ্রাইড উইলহেম লিবনিজ চাকা ও দন্ড দিয়ে পৌনঃপনিক যোগ করার একটি যন্ত্র তৈরি করেন। এরপর স্যার স্যামুয়েল মরল্যান্ড ১৭৮৬ সালে একটি গণনা যন্ত্র তৈরি করেন। ১৮৮২ সালে চার্লস ব্যাবেজ যে যন্ত্রটি তৈরি করেন তাকেই আজকের দিনের কম্পিউটারের পূর্বপুরুষ মনে করা হয়। চার্লস ব্যাবেজের পরেই ১৯৪০ সালে মার্ক-১ বাজারে আসে। এটি একটি মেক্যানিকাল যন্ত্র ছিল। ১৯৫১ সালে উইনিভ্যাক নামে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক কম্পিউটার ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে।
১৯৭১ সালে বাজারে আসে মাইক্রোপ্রসেসর। আবার ১৯৭৪ সালে বাজারে আসে ৮০৮০ প্রসেসর আর এই মাইক্রোপ্রসেসর দিয়ে তৈরি কম্পিউটার সারা দুনিয়ায় কম্পিউটার বিপ্লবের সূচনা করে। কম্পিউটারের ক্রমবিকাশের ধারণাকে পাঁচটি প্রজন্মে ভাগ করা হয়।
প্রাথমিক ও মেকানিক্যাল যুগের এবং ইলেক্ট্রনিক যুগের প্রথম কম্পিউটার গুলোকে প্রথম প্রজন্মের কম্পিউটার বলা হয়। ট্রানজিস্টের আবিস্কার হওয়ার পর ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত যেসব তৈরি হয়েছে সেগুলোকে দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার বলা হয়।
তৃতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার হল ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭১ সালে আবিস্কৃত মাইক্রোপ্রসেসরের সাহায্যে প্রস্তুতকৃত কম্পিউটার গুলোর পূর্ব পর্যন্ত প্রস্তুত কম্পিউটার সমূহ। মাইক্রোপ্রসেসর দিয়ে তৈরি সাম্প্রতিক কম্পিউটার সমুহকে চতুর্থ প্রজন্মের কম্পিউটার বলা হত। আবার সাম্প্রতিক কালে অতি উন্নত ও ব্যাপক ক্ষমতাবান মাইক্রো প্রসেসর দিয়ে অত্যাধুনিক যেসব কম্পিউটার তৈরি হচ্ছে সেগুলোকে পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার বলা হয়।
আধুনিক কম্পিউটার এর বিকাশ শুরু হয় ষাটের দশেকের প্রথম থেকেই। ঐ সময় থেকেই ইউরোপ-আমেরিকায়ও কম্পিউটারের ব্যবহার ও প্রসার লাভ করতে থাকে। ঠিক একই সময়ে বাংলাদেশে কম্পিউটার ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকায়। তখন পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকা ছিল তৎকালীন পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনের পূর্বাঞ্চলীয় শাখা। বাংলাদেশে প্রথম কম্পিউটার ছিল আইবিএম ১৬২০ মডেলের।কম্পিউটারের জঅগ ছিল মাত্র ২০ কিলোবাইট। পরে এর পরিমাণ বাড়িয়ে ৬৪ কিলোবাইট করা হয়। বাংলাদেশে স্থাপিত প্রথম কম্পিউটারে ইনপুট দিতে হতো পাঞ্চকান্ডের সাহায্যে এবং আউটপুট পাওয়া যেত পাঞ্চকার্ডে। ১৯৮২-৮৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের আইবিএম ৪৩৪১ মেইনফ্রেম কম্পিউটারটি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সাভারে অবস্থিত পরমাণু শক্তি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ইন্সটিটিউটে স্থাপন করা হয়।
১. তথ্যের নির্ভুলতা:
মূলত, এই যন্ত্র আবিষ্কার করার উদ্দেশ্যই ছিল নির্ভুল গণনা ও তার সঠিক ফল প্রকাশ। আমরা সকলেই জানি, যে কম্পিউটার ইনপুট-প্রসেস-আউটপুট এই পদ্ধতিতে কাজ করে।
অর্থাৎ, আমরা গণকযন্ত্রকে কোনো তথ্য পাঠাই এবং সেই তথ্য এই যন্ত্রটি অসংখ্য সূক্ষ বৈদ্যুতিক বর্তনীর সাহায্যে গণনা করে সঠিক ফলাফল দিয়ে থাকে।তাই, মানুষের করা গণনার থেকে যন্ত্র-নির্ভর গণনা অনেকটাই নির্ভুল ও যুক্তিসঙ্গত। তবে, মানুষ যদি ভুল তথ্য প্রদান করে, তবে কম্পিউটার সেখানে ভুল তথ্যই সরবরাহ করবে, এবং তখন তাকে আমরা গার্বেজ ইনপুট ও গার্বেজ আউটপুট বলে থাকি।
২. উচ্চ গতিসম্পন্নতা:
গণকযন্ত্র নির্ভুলভাবে গণনার পাশাপাশি দ্রুতগতিতে ফল ঘোষণা করতেও সক্ষম। যেহেতু, এই যন্ত্র বৈদ্যুতিক সংকেতের সাহায্যে কাজ করে, তাই এই যন্ত্র মাইক্রো, মিলি, ন্যানো পিকো সেকেন্ডের মধ্যে ফলাফল বের করে দিতে পারে। একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটার গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ৩০ থেকে ৪০ লক্ষেরও বেশি গাণিতিক প্রব্লেমের সমাধান করতে পারে।
৩. ত্রুটি সনাক্তকরণ ও সংশোধন:
মানুষের ভুল নির্ধারণ ও পরবর্তীতে সংশোধন করার ক্ষমতা এই যন্ত্রের তুলনায় অনেকটাই কম। এই যন্ত্রগুলো এমনভাবেই প্রোগ্রাম করা হয়, যা অতি দ্রুত ভুল সনাক্ত করতে ও সংশোধন করতে সক্ষম।
৪. মেমরি:
কম্পিউটারের মেমোরি বা স্টোরেজ স্পেস অনেকটাই বেশি থেকে থাকে। যার ফলে, অসংখ্য কিংবা কোটি কোটি তথ্য কম্পিউটারের মধ্যে জমা রাখা সম্ভব। মানুষের থেকে ইনপুট পাওয়া মাত্রই এই যন্ত্র চট করে ও নির্ভুলভাবে সেইসব তথ্য দেখতে বা ব্যবহার করতে পারে। একটি কম্পিউটার বছরের পর বছর কোটি কোটি তথ্য কোনোরকম অসঙ্গতি ছাড়াই সেভ বা জমা রাখতে পারে।
৫. বিশাল তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা:
এই যন্ত্র মানুষের দেওয়া তথ্য ইনপুট আকারে গ্রহণ করে, সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে আউটপুটের আকারে তা প্রদর্শন করে। তাই, জটিল গাণিতিক হিসাব থেকে শুরু করে তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ সবকিছুর সঠিক প্রক্রিয়াকরণের জন্যেই মানুষ এই যন্ত্রেই উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
৬. লজিকাল ডিসিশন মেকিং:
কম্পিউটারের সমস্ত প্রক্রিয়াই নির্ভর করে যুক্তির উপর। যেহেতু, এই যন্ত্রের নিজস্ব বুদ্ধি বা বিচার করার ক্ষমতা এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে দেওয়া হয়নি। এই কারণেই, গণকযন্ত্র গুলো প্রোগ্রামে দেওয়া যুক্তির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত প্রকাশ করে।
৭. অক্লান্ত কর্মক্ষমতা:
মানুষের দিনে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা মতো বিশ্রাম নেওয়ার প্রয়োজন থাকে। কিন্তু, কম্পিউটারের মতো যন্ত্র নিরলসভাবে একটানা কাজ করে যেতে সক্ষম।
৮. সূক্ষ প্রক্রিয়াকরণের ক্ষমতা:
মানুষ যতই জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হোক না কেন, সূক্ষ গাণিতিক বিশ্লেষণে কম্পিউটারের মতো পাকা হিসেবি ও সঠিক উত্তর প্রদান মানুষের পক্ষে সবসময় দেওয়া অসম্ভব। তাই, কম্পিউটার যেকোনো গাণিতিক সমস্যার ফল যদি দশমিকের ঘর অতিক্রম করে, তবে সেই উত্তরও সে নির্ভুলভাবে প্রকাশ করতে পারে।
৯. বহুমুখতা:
একটি গণকযন্ত্র মাল্টিটাস্কিং বা একসাথে অনেকগুলো কাজ করতে সক্ষম। গাণিতিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি এই যন্ত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা, তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা, এন্টারটেইনমেন্ট, শিক্ষা ও টেলিকমুনিকেশন, ও আরও নানানধরণের কাজ করতে পারে।
১০. স্বয়ংক্রিয়তা:
কম্পিউটারকে তথ্য প্রদান বা ইনপুট দিলে বাকি সমস্ত কাজটা সে একাই করতে পারে। এই প্রসেসিং করার জন্য একটি গণকযন্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবেই কাজ করতে পারে।
Compute শব্দের অর্থ হিসাব বা গণনা করা। আর কম্পিউটার (Computer) শব্দের অর্থ গণনাকারী যন্ত্র। কিন্তু এখন আর কম্পিউটারকে শুধু গণনাকারী যন্ত্র বলা যায় না। কম্পিউটার এমন এক যন্ত্র যা তথ্য গ্রহণ করে এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তা বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করে।